বিইস্মিহি তা‘আলা
তাছাউফের সারবস্তু ৮টি জিনিস। এই ৮টি জিনিস সবই আল্লাহ্ তা‘আলার কালামুল্লাহ্ শরীফে সূরা মুযাম্মিলের শুরুতে উল্লিখিত আছে ঃ
(১) يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا …. (২) وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا … إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا … (৩) وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ (৪) وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا (৫) رَّبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلًا (৬) وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ (৭) وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا (৮) وَذَرْنِي وَالْمُكَذِّبِينَ أُولِي النَّعْمَةِ وَمَهِّلْهُمْ قَلِيلًا –
আল্লাহ্ তাঁহার পিয়ারা হাবীবকে সম্মোধন করে বলেন, “হে কামলিওয়ালা দোস্ত! (১) রাত্র জাগরণ করুন, রাত্র জাগরণের সাধনার দ্বারাই নফসের ইসলাহ হবে এবং কথা বলার কর্তব্য পালন করার ঢং শিক্ষা হবে। (২) রাত্রি জাগরণ করে, ধীরে ধীরে চিন্তা করে করে, বুঝে বুঝে স্পষ্টভাবে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করুন। (৩) আল্লাহ্র নাম যপ করুন, আল্লাহ্র যিকির করুন। (৪) অন্য সব চিন্তা, সব খেয়াল দূরে নিক্ষেপ করে সব থেকে কর্তিত হয়ে এক আল্লাহ্র দিকে একাগ্র চিত্তে ঝুঁকে পড়–ন। (৫) আপনার প্রভু আল্লাহ্ এমন যে, মাশরিক-মাগরিব সমস্ত সৃষ্টির আহার যোগাচ্ছেন, তাদেরকে পালন করতেছেন। সেই একজন ছাড়া অন্য কোন পালনকর্তা নেই, অতএব আপনাকেও তিঁনি পালবেন, সুতরাং তাঁকেই আপনার কার্য সমাধাকারী ধার্য করে নিন। (৬) লোকেরা যা আপনাকে টিটকারী, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে হয়ত গালি-গালাজ করবে, সেসব আপনি নীরবে সহ্য করবেন। (৭) আর তাদের আলোচনা মোটেই করবেন না, তাদেরকে মন্দও বলবেন না; ভদ্রভাবে, মহৎভাবে তাদের আলোচনা বাদ দিবেন। (৮) আর যারা ধর্মদ্রোহী অথচ আমি কেন তাদেরকে নাজ ও নিয়ামতের সঙ্গে পালন করতেছি, এ কথার চিন্তা-চর্চা ছেঁড়ে দিবেন, কিছুদিনÑ অল্পদিনের জন্য তাদেরকে ভোগ করার সুযোগ দিন, তার জন্য লালায়িত হবেন না।”
হাদীছ শরীফে এসেছে ঃ
سيد القوم خادمهم فمن سبقهم بخدمة لم يسبقوه بعمل الا الشهادة –
অর্থাৎ দলপতি নেতা তিনিই সাব্যস্ত হবেন যিনি দলের লোকদের খিদমত বেশি করেন এবং যিনি খিদমত বেশী করেন তিনি দলপতি বা নেতা নির্বাচিত হবেন। যিনি খিদমতের মধ্যে অগ্রনী হবে অন্য কোন আমল ইবাদত বন্দেগীর দ্বারা অন্য লোকেরা তাকে পিছনে ফেলতে পারবে না, অবশ্য যাঁরা আল্লাহ্র রাস্তায় গলা কর্তিত হয়ে শহীদ হবেন তাদের কথা স্বতন্ত্র। খিদমতের অর্থ নিজেকে ছোট করে, নিজের হক্বকে ছোট করে, নিজের আরামকে ছোট করে অন্যের হক্বকে, অন্যের আরামকে, অন্যের সম্মানকে বড় করে নিজে খিদমত না নিয়ে অন্যকে আরাম পৌছান, অন্যকে বেশী সম্মান দান করা, নিজের হক্ব অন্যরা কেউ দিক বা না দিক, তবুও অন্যদের হক্ব কড়ায় গন্ডায় আদায় করা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে ¯েœহদান করা, সমাজের উলামাকে যোগ্য মর্যাদা দান করা, অন্যের ব্যাথা ও কষ্টকে নিজ কষ্ট অপেক্ষা বেশি অনুভব করা ইত্যাদি। অন্ততঃ এতটুকু হলেও সোনার সামাজ গঠিত হতে পারে দুনিয়াতে এবং ইহাই তাছাউফ ও তরীকতের আসল উদ্দেশ্যে।
মানুষের মধ্যে ভাল আখলাক তৈরী করা এবং মন্দ খাসলাত দূর করার কাজ তাছাউফের। ইহা হক্কানী কামিল পীরের সোহবত ও তালিম ছাড়া আর অন্য কোথায় হয়? অতএব খাঁটি তাছাউফের খাঁটি পীরের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
আসল কথা এই যে, তাছাউফের সত্যিকার বিষয়-বস্তুগুলির সবই কুরআন হাদীসে উল্লেখ আছে। কুরআন হাদীছের বাহিরের বিরোধী জিনিসকে কিছুতেই তাছাউফ বলা যাবে না।
মূর্খতাবশত ঃ কেউ কেউ তদবীর চেষ্টা না করাকে, হালাল রুযির জন্য কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়, চাকুরী মজুরী ইত্যাদি পেশা অবলম্বন না করাকে কাজ-পরিশ্রম না করাকে তাওয়াক্কুল মনে করে এবং বিবি বাচ্চার ভরণ-পোষণের বোঝা বহন না করাকে, সুবিচার-সুশাসনের, দায়িত্বের-কষ্টের বোঝা গ্রহন না করাকে তাছাউফ বা বুযুর্গ মনে করেÑ ইহা তাহাদের মারাত্মক ভুল।
তাছাউফের আসল মাকসুদ বা উদ্দেশ্য নিসবত হাসিল করা। অর্থাৎ সব সময় আল্লাহ্র কথা স্বরণ রাখা, কোন সময় যেন আল্লাহ্র কথা ভুলে না যায়, সব সময় আমি আল্লাহর অধীনস্থ দাসÑ একথা স্বরণ রাখা এবং দাসের কাজ প্রেমের সঙ্গে, ভক্তির সঙ্গে সর্বদা প্রভুর যখন যে আদেশ হয়, তখনি তা পালন করা, কখনও প্রভুর আদেশ লঙ্ঘন না করা, নিষিদ্ধ কাজের কাছে না যাওয়া, এই নিসবত হাসিল করাই তাছাউফের আসল মাকসুদ।
প্রশ্ন ঃ ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজ, না ওয়াজিব, না সুন্নাত, না মুস্তাহাব?
উত্তরঃ তাছাউফের মধ্যে চার প্রকার জিনিস শিক্ষা দেওয়া এবং আমল করা হয়।
১। পীরের হাতে হাত দিয়ে বাইয়্যাত বা মুরীদ হওয়া।
২। পীরের সোহবতে থাকা
৩। নফসের ইসলাহ করা।
৪। পীরের তরীকা অনুযায়ী খাস যিকির করা।
এই চার প্রকার কাজের মধ্যে পীরের তরীকায় খাস যিকির করা। যেমনÑ ছয় লতিফার জিকির, বার তসবীহের যিকির করা ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নাত নয় কিন্তু যার সময় আছে, তার জন্য মুস্তাহাব এবং কামিল-মুকাম্মিল পীর সমাজে বাকি রাখার জন্য, সেই রকম যোগ্য লোক পয়দা করার জন্য যোগ্য মুহাক্কিক হক্কানী পীরের দ্বারা হাসিল করা ফরজে কিফায়া।
সাহাবাগণ তরবিয়ত হাসিল করার জন্য, চরিত্র গঠন করার জন্য দ্বীন জারীর কাজে দুনিয়ার মায়া, জীবনের মায়া পরিত্যাগ করে অটল সত্য থাকার জন্য নবীর হাতে হাত দিয়ে যে শপথ ও অঙ্গীকার করতেন তাকেই বাইয়াত বলে। এখনও হক্কানী-মুহাক্কিক আলিম, সাচ্চা নায়েবে রসূল, বুযর্গ পেলে তার হাতে হাত দিয়ে বাইয়াত হওয়া সুন্নাত। কিন্তু শুধু বাইয়াত হলেই চলবে না; তদ্রুপ জীবনও গঠন করতে হবে।
নফসের ইসলাহ করা অর্থাৎ আক্বীদা দুরস্ত করা, ইবাদত-আমল দুরস্ত করা, রিপু দমন করে, নফসের সঙ্গে জিহাদ করে, মুজাহাদা রিয়াযত করে আখলাক দুরস্ত করা ফরয। এই ফরয পালন করার জন্য সহায়ক হয় কামিল হক্কানী লোকের সোহবত। কাজেই কুসংসর্গ বর্জন করা এবং নেক সোহবত অবলম্বন করা ওয়াজিব। সোহবতের অর্থ কামিল আলিমের সংসর্গে থেকে নিজের ভুল ক্রটিসমূহ তাকে জানিয়ে, তার নিকট জিজ্ঞাসা করে, তার উপদেশ অনুযায়ী আমল করা, কষ্ট করা, সংযম অভ্যাস করা, সাধনা করা। এই উপায়েই মানুষ মানুষ হতে পারে। এইরূপ চরিত্র গঠন করা প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য, চাই তিনি ব্যবসায়ী হন, চাই চাকুরিজীবী হন, চাই রাজ-কর্মচারী বা জজ ম্যাজিস্ট্রেট বা মন্ত্রী-খলীফা হন কারণ চরিত্র গঠন ব্যতিরেকে সর্বদা মানুষ কাম, ক্রোধ, লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্নীতি পরায়ণ হয়ে যায়। যেমন, তার নমুনা আমরা দেখতেছিÑ বর্তমান যুগে এ উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশের ডাক্তার, মাস্টার, উকিল, ব্যারিস্টার, ব্যবসায়ী, শিল্পী, ছোট চাকুরিজীবী, বড় চাকুরিজীবী সর্বত্র অনাচার, কদাচার, দুর্নীতি, ব্যভিচার ছড়ায়ে পড়েছে। এই বিভীষিকা হতে জাতিকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় কুরআন-হাদীসের আলোর দ্বারা হৃদয়কে আলোকিত করে তদনুযায়ী চরিত্র গঠন করা। এ ছাড়া জাতির ধ্বংস অনিবার্য। চরিত্র গঠনের জন্য সৎসংসর্গ অবলম্বন, কিছু দীর্ঘকাল পর্যন্ত অভ্যাসকরণ ও সৎ পরিবেশে কাল যাপন প্রধান সহায়ক।
প্রশ্নঃ পীর ধরার দরকার কি? সাধারণ আলিমদের কাছে ওয়াজ শুনে, মাসআলা জেনে বা বই দেখে আমল করলেই কি তা যথেষ্ট হতে পারে?
উত্তরঃ হ্যা,ঁ প্রাথমিক নিম্মশ্রেণীর দ্বীন বোধ হয় সাধারণ আলিমদের কাছে কিতাব পড়ে বা ওয়াজ-নছীহত শুনে মাসআলা জেনে হাসিল হতে পারে এবং যদি যোগ্য, নিস্বার্থ, ত্যাগী পীর না পাওয়া যায় তবে এই পথই অবলম্বন করা শ্রেয়। কারণ, অযোগ্য বা ঠগবাজ পীর ধরা অপেক্ষা না ধরা ভাল। বরং অযোগ্য ঠগবাজ পীর ধরাতে দারুণ ক্ষতি, চরম সর্বনাশ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা। কিন্তু উচ্চশ্রেনীর কামালিয়াত হাসিল করতে হলে কামিল পীরের খাস তালীম ও তরবিয়ত ব্যতীত হওয়া অসম্ভব প্রায়। কারণ ডাক্তারী, উকালতি শিখতে হলে যেমন বই পড়ার পরও কিছুদিন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে বা অভিজ্ঞ উকিলকে কাজ করে দেখাতে হয় এবং জটিল বিষয়ের পরামর্শ নিতে হয়। অনেক বিষয় দেখে বা মৌখিক শুনে শিখতে হয়; কিতাবের দ্বারা বুঝে আসে না। এ জন্যই একজন নির্দিষ্ট পীরের দরকার হয়। কিন্তু পীর কামিল মুকাম্মাল আলিম ও আমলী হওয়া চাই; নিস্বার্থ, ত্যাগী, দরদী, বিনাপারিশ্রমিকে পরের জন্য পরিশ্রমের ত্যাগ স্বীকারকারী হওয়া চাই। এই ধরনের ত্যাগী কিছু সংখ্যক পীর সমাজে থাকা একান্ত জরুরী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ পীরদের অযোগ্যতা বা ভন্ডতার কারনে পীরের সংখ্যা এত বেড়ে যাওয়া সত্তেও সমাজের সেবা হচ্ছে না, দ্বীন জারী হচ্ছে না বরং হিতের চেয়ে অহিত বোধ হয় বেশি হচ্ছে। স্বর্থ এসে গেছে, দুনিয়ার মুহাব্বত এসে গেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে ধোকাবাজিও এসে গেছে। আল্লাহ্ এই কুষ্ঠব্যাধি হতে আমাদের সামাজকে নাজাত দিন। বাতিল পীর ধোকাবাজপীর ধরার চাইতে মোটেই পীর না ধরে শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েল জেনে তদনুযায়ী আমল করা ভাল। কেননা, ইঞ্জিন যদি খারাপ হয়, তাহলে গাড়ী একেবারে অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে পারে। গলদ ইঞ্জিনের গাড়ীতে চড়া অপেক্ষা মোটেও গাড়ীতে না চড়ে পায়ে হাঁটা ভাল। যোগ্য পীরের আলামত কমপক্ষে পূর্ণ কুরআনের এবং একখানা হাদীছ গ্রন্থের মানে-মতলব উস্তাদের কাছে বুঝে পড়েছেন এবং চর্চা রেখেছেন এতটুকু হওয়া আবশ্যক। তদুপরি আখলাকের তরবিয়ত দেওয়ার যোগ্যতা, নফসের ইসলাহ করার যোগ্যতা, তিনি অর্জন করেছেন কোন পীরে কামিলের সোহবতে থেকে। যিকিরে দ্বারা নিসবত হাসিল করেছেন তাহারও সনদ থাকা দরকার এবং মুরীদ করিয়া নিজের স্বার্থ উদ্ধার করবেন, দুনিয়ার নাম-নুমায়েশ প্রসার, সস্পত্তি করবেন এই খাহেশ তার নেই। শুধু আল্লাহ্র দ্বীন নবীর তরীকা জারী করাই তার উদ্দেশ্যÑ ইহারও প্রমাণ থাকা দরকার। পরস্পর দ্বীনের খাদিমগণের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মতপাথর্ক্য না থাকা দরকার। সকল খাদিম-ই এক নবীর তরিকার খাদিম, এক নবীর দরবারের চাকর, পরস্পর একতা, মহব্বত, সহযোগিতা-সহানুভূতি, খায়েরখাহী, হামদর্দী থাকা দরকার। যেখানে টাকা ও স্বার্থের প্রশ্ন, সেখানেই আসে দ্বন্দ-ঝগড়া, আর যেখানে সকলের একই উদ্দেশ্য, একই আল্লাহ্কে পাওয়া, একই নবীর পায়ের তলে সকলকে হাযির করা, সেখানে দ্বন্দ-ঝগড়া, হিংসা-বিদ্বেষ থাকিবে কেন?
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! আমি আর একটি কথা বলতেছি, খুব গওর করে, গভীর চিন্তা করে বুঝে নিন। আমি তাছাউফকে এবং পীর ধরাকে মুস্তাহাবও বলেছি, ওয়াজিবও বলেছি, এমনকি ফরযও বলেছি। কিন্তু খবরদার!! ধোকাবাজের যামানা, মিথ্যার যামানা, স্বার্থের যামানা, এই যামানায় ধোকাবাজের সংখ্যা বেশী, মিথ্যাবাদীর সংখ্যা বেশী। খাঁটি সত্য কামিল পীর, খাঁটি সত্য তাছাউফ সত্য সত্য পরশ পাথর হতে বেশী মূল্যবান, বেশী মর্যাদা শীল। কিন্তু অখাঁটি তাছাউফ এবং অখাটি অসত্য ধোকাবাজ পীর চোর-ডাকাত হতে বেশী অপকারী, বেশী সর্বনাশকারী। সাপের সংসর্গ ভাল, তবুও ধোকাবাজ পীরের সংসর্গ ভাল নয়। মাওলানা রূমী রহ. বলেছেনÑ
اي بسا ابليس ادم رو ئے ھست
بس بهر دست نبا يدداد دست
يار بد بد تر بود از مار بد
প্রিয় ভ্রাতৃবর্গ! অনেক ইব্লিস মানুষের সুরত ধরে পীর সেজে ঘুরিয়া বেড়াচ্ছে। অতএব খবরদার! যাচাই-বাছাই না করে খাঁটি-অখাঁটি না চিনে কারও হাতে হাত দিবেন না। নিশ্চয়ই জানবেন, ধোঁকাবাজ পীরের সংসর্গ বিষধর সাপের সংসর্গ অপেক্ষাও বেশী অনিষ্টকর, বেশী সর্বনাশা।
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. শেষ জীবনে বার বার বলতেনÑ
“বর্তমান যুগে অলিতে গলিতে যেসব ধোকাবাজ-ঠগ পীর নামে অভিহিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়, এইসব ডাকাত এবং এইসব ঈমান লুন্ঠনকারী ঠগদের সংসর্গে না গিয়ে মানুষের জন্য ইহাই বরং শ্রেয় যেÑ তারা জাহেরী শরীয়তের কিতাব দেখে, জাহেরী শরীয়তের আলিমদের কাছে জিজ্ঞাসা করে, শরীয়তের মাসআলা-মাসায়েল অবগত হয়ে নিজেদের জীবন ও চরিত্র গঠন করেন, নিজ নিজ মুক্তির পথ খোঁজেন এবং নিজ নিজ আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।”
এই ভিত্তিতে এবং এই সূত্রে আমি আমার আলিম উলামা এবং পীর বুযর্গ ভাইদের করজোড়ে অনুরোধ জানাইÑ আপনারা খাঁটি হন; অন্ততঃ কুরআনের ভাষায় আদ্যোপান্ত তার মানে-মতলব হৃদয়ঙ্গম করুন। অন্ততঃ একখানা হাদীসের কিতাব আসল আরবী ভাষায় আদ্যোপান্ত কোন উস্তাদের কাছে পড়–ন। তারপর জনসাধারণকে আসল শরীয়তের দিকে, আসল তাছাউফ ও মারেফাত, তরীকত হাকীকতের দিকে আকর্ষণ করুন। খবরদার! অস্থায়ী দুনিয়ার ক্ষনস্থায়ী কিছু টাকা পয়সা বা মান সম্মানের জন্য চিরস্থায়ী আখিরাতকে ডুবাবেন না। শায়েখ সাদী কী আবেগভরেই না বলেছেনÑ
“সেই নীচাশয় হতভাগা কক্ষনো শান্তির মুখ দর্শন করবে না, যে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জন্য, টাকা-পয়সা বা দুনিয়ার মান-সম্মানের জন্য দ্বীনকে বরবাদ করবে।
মাওলানা রূমী কত দরদের সাথে বলেছেনÑ
“নীচাশয় ব্যক্তিরা খাঁটি দরবেশী না শিখে খাঁটি ত্যাগ ও কুরবানী, ইত্তেবায়ে শরীয়ত, তরীকত ও পায়রবীয়ে সুন্নাত মশক না করে দরবেশের কিছু কথা চুরি করে তার দ্বারা সরলপ্রাণ অজ্ঞ জনসাধারণকে ধোকা দিয়ে মন্ত্র-মুগ্ধ করে ফেলে।”
খবরদার! তাদের ধোকা হইতে দূরে থাকিও। আমি আমার মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দের নিকটও সনির্বন্ধ আরয জানাইÑ খাঁটি-মেকি চিনতে চেষ্টা করুন, চেষ্টা করলে খাঁটি-অখাঁটি চিনতে পারবেন। খবরদার! মেকী সোনা, জাল নোট ঘরে নিবেন না, নতুবা উল্টা চিটিং কেসে সোপর্দ হওয়ার আশঙ্কা আছে। নিজে এল.এল.বি পাস না করে যেমন বড় উকিল কেÑ তা আপনারা চিনতে পারেন, এম.বি.বি.এস পাস না করে যখন আপনারা কে বড় ভাল ডাক্তার তা চিনতে পারেন, তখন খাঁটি পীর অনুসন্ধান করলে কেন চিনতে পারবেন না? ভেলকিবাজিতে মুগ্ধ হবেন না, শরীয়তের মাপকাটি ছেড়ে শুধু প্রবৃত্তির ভাব-প্রবণতায় কাজ করবেন না। সব জায়গায় শরীয়তের মাপকাটি ঠিক রাখবেন।
হাদীস শরীফে এসেছেÑ
“যে ইলম হাসিল করবে দুনিয়ার হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে, দুই চারটি পয়সা পেয়ে পেট পালবার উদ্দেশ্যে অথবা এই উদ্দেশ্যে যে, লোকেরা তার দিকে ঝুঁকুক এবং তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিক অথবা এই উদ্দেশ্য যে, অন্য আলিমদের সঙ্গে তর্কে জিতুক অথবা এই উদ্দেশ্যে যে, সে বোকাদের ধোঁকা দিয়ে তার তাবেদার বানাক, এইসব উদ্দেশ্যে যে ইলম হাসিল করবে তার স্থান দোযখের মধ্যে স্থির করে রাখুক।”
আল্লাহ আমাদের সকলকে একযোগে সত্যান্বেষী ও সত্য-সেবী হওয়ার তৌফিক দিন। হিংসা-বিদ্বেষ মতপার্থক্য, হীনতা-নীচতা, ধোঁকা-ফাঁকি আমাদের হতে দূর করে দিন। আমীন ছুম্মা আমীন। বে হুরমাতে সাইয়্যেদিল মুরসালীন খাতামুন্নাবীয়্যীন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া বারাকা ওয়াসাল্লাম।